সিউলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস তিনটি ভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২১ পালন করেছে। রাষ্ট্রদূত দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান সিটিতে অবস্থিত শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
মহামারির প্রেক্ষিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার ঘোষিত সামাজিক দূরত্ব কার্যক্রম অব্যাহত থাকার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে প্রভাতফেরি ও পুষ্পস্তবক অর্পণ অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। দূতাবাস প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রদূত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। সামাজিক দূরত্ব অব্যাহত থাকার কারণে দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
এরপর দূতাবাসে অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। অনুষ্ঠানের পরবর্তী অংশে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ, ভাষা শহীদদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নীরবতা পালন, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও ইউনেস্কোর মহাপরিচালকের প্রদত্ত বাণীসমূহ পাঠ করা হয়।
উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে দিবসটির তাৎপর্যের ওপর আলোচনা করা হয়। আলোচনায় মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভে ভাষা শহীদদের চূড়ান্ত আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং মাতৃভাষার মর্যাদা ও সম্মানকে সমুন্নত রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা ‘বাংলা’-এর মর্যাদা রক্ষায় যে সকল ভাষা শহীদেরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন যে তার ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে, ১৯৫২ হতে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধিকারের বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
তিনি বলেন, এ বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুভাষাবাদকে উৎসাহিত করা’-কে উপজীব্য করে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগসমূহ তুলে ধরেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে দূতাবাস ১৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়াস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিকরা, দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কোরিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর ইউনেস্কো (কেএনসিইউ)-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক, কেএনসিইউ-এর মহাসচিব, পূর্ব তিমুর, পাপুয়া নিউ গিনি, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতরা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং গিওরমাল-কেওনসাজিওন-এর মহা-সচিবসহ বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকরা অংশহগ্রহণ করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে ভাষা শহীদদের স্মৃতির উদ্দশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’-২১শে ফেব্রুয়ারির এই গানটি পরিবেশন করা হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর শুভেচ্ছা বক্তব্য ও বহুভাষাবাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের উন্নয়নের উপর দেশভিত্তিক গৃহীত কার্যক্রমের উপর আলোচনা অনুষ্ঠান হয়।
অনুষ্ঠানে দূতাবাস আয়োজিত মহান শহীদ দিবস ও কোরিয়ার হাঙ্গুল দিবসের সামঞ্জস্যের ওপর নির্মিত একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া, অনুষ্ঠানে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলা ভাষা প্রসারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দূতাবাস কর্তৃক সম্মাননা প্রদানকৃত দুইজন বাংলাদেশি নাগরিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম তার স্বাগত বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আত্মৎসর্গকারী ভাষা শহীদদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। মুজিব বর্ষ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপনের বিষয়টি উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ৫০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন, ২১ বছর আগে ইউনেস্কো মহান শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে একুশের চেতনা বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে যার মাধ্যমে আমরা ভাষাগত বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাতে সক্ষম হয়েছি।
এ বছরের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ‘শিক্ষা ও সমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য বহুভাষাবাদকে উৎসাহিত করা’-উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম টেকসই উন্নয়ন এবং সবার সমান অংশীদারত্ব নিশ্চিতকরণে বহুভাষাবাদ বিকাশ ও প্রচারের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
ইউনেস্কো সম্পর্কিত কোরিয়ান জাতীয় কমিশনের মহাসচিব হান, কিউং কো তার বক্তব্যে দুই কোরিয়ার নৃতাত্তিক ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি দুই কোরিয়ার বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় কোরিয়ান ভাষার ওপর একটি অভিন্ন অভিধান সংকলনের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেন।
ঔপনিবেশিকতা হতে মুক্তি ও মাতৃভাষার জন্য সংগ্রামকে দুই দেশের ইতিহাসে এক অভিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ব্যুরোর মহাপরিচালক কিম জুংহান তার বক্তব্যে মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, উভয় দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, জাতির পরিচয় বহনে, সক্ষমতা এবং স্বাধীনতা অর্জনে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। তিনি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূল্যবোধগুলো যেমন বহুভাষাবাদ সংরক্ষণে ও এর বিকাশে বহুপাক্ষিকতা, সহ-অস্তিত্ব এবং সংহতির ওপর জোর দেন।
এরপর, পূর্ব তিমুর, পাপুয়া নিউ গিনি, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতরা তাদের বক্তব্যে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন এবং এই ঐতিহাসিক দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের অনুমোদন প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর প্রশংসা করেন।
এছাড়া, তারা বহুভাষাবাদের উন্নয়নে তাদের দেশ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর বিস্তারিত বক্তব্য প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং গিওরমাল-কেওনসাজিওন-এর মহাসচিব বহুভাষাবাদের উন্নয়নে তাদের সকারের বিভিন্ন উদ্যোগগুলি তুলে ধরেন।
পূর্ব তিমুরের সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রদূত আদলগিসা মারিয়া সোয়ারস জেমিনেস বলেন, তার দেশ বহুভাষাবাদ সংরক্ষণে ও বিকাশে বদ্ধপরিকর। পূর্ব তিমুর মূলত দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক দেশ যেখানে জনসংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ। সেখানে সরকারি ভাষা-পর্তুগিজ ও তেতুম ছাড়াও ১৬টি ভিন্ন ভাষা রয়েছে।
ভারতের রাষ্ট্রদূত শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথন তার বক্তব্যে বিশ্বকে মাতৃভাষা ও বহুভাষিকতার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করার জন্য বাংলাদেশের উদ্যোগগুলির প্রশংসা করেন। তিনি জানান, ভারতে ২১টি প্রধান ভাষা রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ভাষাভাষী, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মানুষেরা তাদের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি হিন্দি ও ইংরেজী ভাষায় কথা বলে থাকে।
নেলসন ম্যান্ডেলার মেয়ে এবং দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত জেনানি এন ডামিনি তার বক্তব্যে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, তার দেশেও ভাষার জন্য মানুষ জীবন উৎসর্গ করে। তাদের স্মরণে ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘যুব দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে।
তারপরে বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারী ভাষা হিসাবে বিভিন্ন মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।
তিনি জানান, বর্ণবাদ প্রথা চলাকালীন মাত্র দুটি ভাষা- ইংরেজী এবং আফ্রিকান সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ছিল। তার পিতা নেলসন ম্যান্ডেলা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন ১১টি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং ১১টি সরকারি ভাষার মধ্যে ৫টি ভাষায় বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়ে থাকে।
পাপুয়া নিউ গিনির রাষ্ট্রদূত অ্যান্ড্রু ইয়ামানিয়া দেশকে সংস্কৃতি ও ভাষার বিচারে পৃথিবীর অন্যতম বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, সেখানে ৮০০টিরও বেশি নৃতাত্ত্বিক ভাষা প্রচলিত রয়েছে যা সারা বিশ্বের ব্যবহৃত ভাষার এক-তৃতীয়াংশ। দুঃখজনকভাবে, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অভিবাসনের কারণে পাপুয়া নিউ গিনির বেশ কয়েকটি স্থানীয় ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছে বলে তিনি জানান। দেশের বিভিন্ন ভাষাগুলি সংরক্ষণের জন্য তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী তার প্রেরিত বক্তব্যে দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন।
সেইসাথে, কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশসহ মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষা চালুর কথা উল্লেখ করেন। গিওরমাল-কেওনসাজিওন-এর মহাসচিব মিস মো সুন-ইয়াং তার ধারণকৃত বক্তব্যে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত কোরিয়ান ভাষা সংক্রান্ত একটি অভিন্ন সংবিধান সংকলনের চলমান প্রকল্প সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
তিনি জানান, ২০০৪ সাল থেকে উভয়পক্ষ এ সংক্রান্ত মোট ২৫টি যৌথ সভা করে ৩০ হাজারেরও বেশি শব্দ অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে একমত হয়েছে।
পরিশেষে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে বাংলাদেশ, ভারত এবং কোরিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের ধারণকৃত পরিবেশনা প্রদর্শন করা হয়।